Thursday, June 9, 2016

ফিরে তাকাই ...


স্থান, কাল আর পাত্রের দ্রুতগামী পরিবর্তনশীলতার মাঝে আজ যখন মনের দূরবীনে চোখ রাখি প্রায় বছর কুড়ি আগে - মুহুর্তে পৌঁছে যাই জীবনের এক অনন্য পর্বে - যেখানে একটা লাল বাড়ি, সামনে সবুজ ঘাস, সাদা গোলপোস্ট, 'আজকাল' খবরের কাগজে মলাট দেয়া বই-খাতা, কালো ফ্রেমের চশমা পরা কয়েকজন মধ্যবয়সী প্রণম্য চেহারা, সাদা জামা - নীল প্যান্ট পরা কয়েকটা কচি কিশোর আর মনের মধ্যে এক অদ্ভূত প্রশান্তি।  আস্তে আস্তে  দূরবীনের ফোকাস ডায়ালটা ঘোরাচ্ছি, আর  ছবিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে - মুখগুলো অতি চেনা, প্রিয়, কাছের।

হরিনাভি-সুভাষগ্রাম-কোদালিয়া-রাজপুর অঞ্চলের আর পাঁচটা ছেলের মত আমার ও একটা লক্ষ্য ছিল হরিনাভি স্কুলে পড়বার - কতকটা পরম্পরা, ঐতিহ্যের মতো। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত আমার পঠন-পাঠন এই স্কুলে। সবার মতই এই সময়টা আমার কাছে অসংখ্য ছোট-বড়, টক-ঝাল-মিষ্টি স্মৃতিতে ভরপুর। আজ যখন এই স্মৃতিকথা চারণ করতে বসেছি - তখন মনে হচ্ছে আমার সেই স্মৃতিসম্ভারে কাল এবং পাত্রের ভূমিকা বড়ই তাত্পর্যপূর্ণ।  আজ যারা এই লেখা পড়বে, তারা হয়ত অনেকেই সেই সব টিচারকে দেখেনি, জানে না।  আমি বা আমার সহপাঠীরা সেই সব ছোটো ছোটো স্মৃতি থেকে যতটা হাসির উপাদান পাবো  - সবাই কি সেটা পাবে? তাই মনে হলো সেই সব অমূল্য রত্নগুলো খুঁজে বের করি - যা আজও অমলিন এবং যা কাল ও পাত্রের  বিচারে আজও একইভাবে প্রযোজ্য।

ক্লাস ফাইভ থেকে টেন/মাধ্যমিক - এ সময় আমরা কতকিছু শিখি। কত নতুন দিগন্ত আমাদের সামনে রোজ ভেসে ওঠে। সেসময়ের শেখাগুলো অমূল্য - কিন্তু পরিস্থিতির পাকচক্রে, আজ দৈনন্দিন দিনপঞ্জিকায় - তার কতটুকু আর ব্যবহার করি? এই খোঁজ করতে গিয়ে দেখলাম - হ্যাঁ, কম্পিউটার সাইন্স এর কচকচির মাঝে আজ পীথাগোরাস ব্রাত্য হতে পারেন বটে - কিন্তু কিছু শিক্ষা, যা অনেক বেশি ব্যাপ্ত, যা জীবন-বোধের, তার ব্যবহার আমাদের কাছে আমৃত্যু।

হরিনাভি স্কুলের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে যে নামগুলো - মিহির চক্রবর্তী, অঙ্কের মাস্টারমশাই। এখনো আপনারা একটু দ্বন্দে আছেন কোন জনের কথা বলছি? দুজনেই অসামান্য - কিন্তু এই মুহুর্তে আমার চারণা দীর্ঘকায় ব্যক্তিবিশেষের। অঙ্ক পড়ানোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল তাঁর গাম্ভীর্য - কিন্তু তার মাঝে ছিল এক সুক্ষ্ম, দুর্লভ রসবোধ, আজকের কেতাবি ভাষায় - unparallel comic timing! ক্লাস নাইনে পড়াতে গিয়ে একদিন খোঁজ দিলেন, এক অদ্ভূত ধারণার - 'infinity'. সে যে অতি বিষম বস্তু, তা আমরা টের পেলাম - ব্যাপারটা কি, তা বুঝতে আমরা যখন সত্যি সত্যিই বিষম খাবার উপক্রম, তখন তিনি বললেন যে infinity হলো "তুমি যা বলবে, তার থেকে এক বেশি বলার" ব্যবস্থা। আজও কি অঙ্কে, কি ধর্মে, কি দর্শনে - যখনই infinity র ব্যবহার দেখি, তাঁর ওই কথা মনে পড়ে। এর থেকে বোধ হয় এটাই প্রতিষ্ঠা হয় - কঠিন কথাও যায় যে বলা সহজে, ব্যুতপত্তির সাহায্যে।

পথের পাঁচালির লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর ছবিটা মনে পড়ে? সেই ছবি যদি বইয়ের পাতা ছেড়ে সামনে এসে উপস্থিত হয়? আমার কল্পনায়, আমি মিল পেতাম চন্দ্রকান্তবাবুর সাথে। শ্যামবর্ণ, সুঠাম, বলিষ্ঠ চেহারা, অসামান্য গাম্ভীর্য, সূক্ষ্য রসবোধ - রসায়নের আদর্শ শিক্ষক। তাঁর ক্লাসে শাস্তি ছিল অদ্ভুত - রোলকলের খাতাটা পরত পিঠের ওপর মাপ-অনুযায়ী। আমাদের এক বন্ধুর সেইরকম এক ভয়ার্ত মুহুর্তে, তাঁর ওই বজ্রগম্ভীর স্বরে শুনেছিলাম - "তাজমহল এর কথা ভাবতে, ভাবতে কি গরুর রচনা লেখা যায়?"| সেই কথার গভীরতা বোঝার বয়স আজ হয়েছে। ছোটবেলা থেকে 'একাগ্রচিত্ত' হবার উপদেশ আমরা সবার কাছে পেয়ে থাকি - কিন্তু তার এত সহজ, সাবলীল বাখ্যা বোধ হয় আর হয় না। কোনো কাজে বুদ্ধি, মন ও প্রতিবর্ত (reflex)-এর একনিষ্ঠতা যে কতটা প্রয়োজন, তা আজ উপলব্ধি করি, আর তাঁর ওই কথা মনে পরে। আজকেই এক খ্যাতনামা business leader-এর উক্তি  পড়লাম -  “Don’t be good at multitasking, rather be well on a single task.”|

'বাংলার বাঘ' আমি দেখিনি, কিন্তু শ্যামলবাবুর সান্নিধ্য পাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। খদ্দরের পাঞ্জাবি, ব্যাকব্রাশ করা রুপোলি চুল, ওজনদার চেহারা, আরো ওজনদার গলা - হরিনশিশুর ন্যায় ছাত্রদের কাছে তিনি ছিলেন, এককথায় - ত্রাস! পরবর্তীকালে যত তাঁর কাছে পৌছেছি, দেখেছি মানুষ হিসেবে তিনি কত কোমল। ছেলেদের ওই ভয়টা বজায় রেখে তিনি যে মজা পেতেন তা বলাই বাহুল্য।  তাঁর কাছে আমাদের ভয় পাবার বা হেনস্থা হবার স্মৃতি প্রচুর এবং এখন তা সুখকর - কিন্তু একটা ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একবার ক্লাসে তিনি আমাদের জিজ্ঞাসা করেন - 'মানে মানে কি?' আমরা নাজেহাল - সঠিকভাবে আমরা এর কোনো সদুত্তর দিয়ে ওনাকে পরিতুষ্ট করতে পারছিলাম না। 'সংজ্ঞা', 'অর্থ', 'তাতপর্য', 'ব্যাখ্যা' - কোনটাতেই তিনি 'হ্যা' বলছিলেন না। কয়েকদিন পরে, উনি জানালেন - 'বলতে যা বোঝায়'। তখন বুঝিনি এই অনুশীলনীর গুরুত্ব কি? আজ বুঝি এই অনুশীলনী আসলে বুঝিয়েছিল যা কিছু  আমরা  সহজেই বুঝি বলে ভাবি, তাতেও নতুন করে খোজার অনেক উপাদান থাকে - সহজভাবে আপাত কোনো সহজ জিনিস ব্যক্ত করার জন্য চিন্তাশীলতাই একমাত্র হাতিয়ার।

যা কিছু প্রচলিত ধ্যানধারণার বিরোধী - তা আমাদের প্রথমেই বিচলিত করে। বাংলার মাস্টারমশাই যদি বলেন রবীন্দ্রনাথকে 'কবিগুরু' বলা যাবে না, নজরুলকে 'বিপ্লবী কবি' বলা যাবে না, তাহলে আমাদের প্রাথমিকভাবে মনে হয় - 'এ কেমন ধারা কথা'? বাংলা পরীক্ষার খাতায় গালভরা বিশেষণ থাকবে না, কারুর উক্তি উদ্ধৃত করা যাবে না - এ কেমন যুক্তি? মনে আছে, এক তাতক্ষনিক বক্তৃতা প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে আমার প্রশংসা করলেও, ক্লাসে বাংলা লেখায় তার কাছথেকে খুব বেশি বাহবা পাই নি। আজ তাঁর কথাগুলোর মর্মপলোব্ধি করতে পারি - 'ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম - তাতে গুরুগম্ভীর শব্দচয়ন বাধাসৃষ্টি করে। সহজ, সরল ভাষায় নিজের চিন্তা ব্যক্ত করাটাই আসল লক্ষ্য। পরীক্ষার খাতায় অন্যলোকের ধার করা শব্দ না লিখে নিজের বিশ্লেষণ লেখাটাই উদ্দেশ্য।' উনি আর কেউ নন - দেববাবু - অনন্য, বৈপ্লবিক চেতনার অধিকারী। আমি সেই দিনের অপেক্ষায় - যেদিন সব সাহিত্যের শিক্ষকরা ওনার এই ধারণা সকলকে শেখাবেন।  

হাতের পাঁচটা আঙ্গুল যেমন সমান হয় না, তেমনই আমরা প্রত্যেকে একে অপরের থেকে ভিন্ন - শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে। মানুষ হিসেবে আমাদের ওস্তিত্ব - বহু মিশ্র, জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়া মাত্র। Effiminacy তাই কোনো রোগ নয়, অস্বাভাবিকতা নয় - বরং একটা কম সম্ভাব্য সম্ভাবনা। আমাদের এরকম কোনো বন্ধুর সাথে এই নিয়ে ইয়ার্কি করাটা যে আমাদের মুর্খতা, অজ্ঞানতার পরিচয় - বরং আমরা যত স্বাভাবিকভাবে তাদের সাথে মিশবো, তারা আরো স্বতস্ফুর্তভাবে অংশ নিতে পারবে। আজ সারা পৃথিবী জুড়ে যখন সবাই LGBT rights নিয়ে সোচ্চার, সেইখানে আজ থেকে বছর কুড়ি আগে এই মান-ও-হুঁশের শিক্ষা, এই মানবিকতার শিক্ষা পেয়েছি অতি নীরবে - আমাদের এক অতি প্রিয় শিক্ষিকা, আশাপূর্ণা ম্যাডামের কাছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ওনার বিশেষ স্নেহধন্য। তবুও আমার মনে হয় ওনার সকল ছাত্রছাত্রীরা ওনার ব্যবহারে এক বিশেষ বন্ধুত্বের উপাদান পায় - যা অনন্য এবং সারাজীবন যত্নে আগলে রাখার মতো। Mechanics - এ relative velocity পড়াতে গিয়ে বুঝিয়েছিলেন 'আপেক্ষিকতা', সামগ্রিকভাবে। আমাদের সব বিশেষণ গুলি যে ভীষণভাবে আপেক্ষিক - তা টের পাই সেদিন। 'তুমি ভালো ছেলে' - কিন্তু কার অপেক্ষা? সেইদিন relative velocity -র vector-এর দিক ভুল হলেও, এটা ঠিক-ই বুঝেছিলাম যে উত্কর্ষ সীমাহীন - ভালোর আরো ভালো হওয়া বাকি থাকে - superlative adjectives are actually myth! আসলে, ওই বিশেষনগুলোও infinity -র মত concept - আর আমাদের নিদারুন প্রচেষ্টা, calculus -এর Limit -এর মত 'approaches' বা 'tends to' মাত্র!

সবার শেষে ওনার কথা বলছি - কারণ ওনার বিরাজ আমার চেতনায় সব চেয়ে বেশী - সুনীল বোসবাবু। এমন খুব কম দিনই যায় যখন তাঁর শেখানো কোনো জিনিস মনে পরে না। কি ইংরেজি, কি বাংলা, কি সাহিত্য, কি সিনেমা, কি রসবোধ, কি শিষ্টাচার - সবই যেন তাঁর শেখানো। তাঁর মত 'total teacher' - আমি জীবনে আর দেখি নি। একটা ক্লাসের সবকটা ছেলে যখন সমানভাবে একজন স্যারের ক্লাসের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে, তখন বোঝা যায় তাঁর কার্যকারিতা কতদূর। সবকিছুই তাঁর কাছ থেকে গল্প শোনার মত। 'full কখনো যুক্ত হলে শেষে, তার একটি পাপড়ি যাবে খসে' - আমরা তাঁর ছাত্ররা কখনো কি এরপর beautiful বা houseful - বানান ভুল করতে পারি? রবীন্দ্রনাথ, ও'হেনরি, সত্যজিত রায়, সলিল চৌধুরী - সবেতেই তাঁর অবাধ বিচরণ। আজ যেটুকু 'sense of humour' আমার মধ্যে আছে, তার বীজ ওনার হাতেই রোপন হয়েছিল। তাঁর কথার মধ্যে দিয়ে ক্লাস নাইন এ পড়তে দেখেছি বিদেশে প্রবাসী বাঙালির জীবনযাত্রা কেমন হয় |  যখন বিতর্কিত কোনো আলোচনা হয়েছে, তখন তাঁর বলা 'from educational point of view' - আজও কানে বাজে। আমাদের দুঃসাহসিক কোনো পদক্ষেপে, আমরা সঠিক হলে - তাঁর অভয় পেয়েছি। তিনি হলেন সময় ও কালের অনেক উর্ধে  - প্রৌড়তাকে  ফাঁকি দিয়ে সর্বাপেক্ষা যুগোপযোগী। তাঁর কাছ থেকে আমরা সব চেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছি জীবন-দর্শনে - গল্পের ছলে তাঁর শেখানো 'Time is the best healer' - কি আমরা কেউ ভুলেছি? একটা কথাই বলার - Hats off Mr. Bose!!!